টাঙ্গাইলে ৪০ বছর ধরে বিদ্যালয় বন্ধ রেখে মাঠে বসছে পশুর হাট!

টাঙ্গাইলে স্কুল বন্ধ রেখে মাঠে বসানো হল পশুর হাট!

টাঙ্গাইল সংবাদদাতা : টাঙ্গাইলে বিদ্যালয় বন্ধ রেখে মাঠে বসানো হয়েছে পশুর হাট। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন ঘাটাইল উপজেলার দিগড় ইউনিয়নের কদমতলী এলাকায় ১৯৭২ সালে কদমতলি হাসান পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

সপ্তাহে প্রতি রবিবার বিদ্যালয়টি ছুটি দিয়ে মাঠে বসে গবাদি পশুর হাট। বিদ্যালয়ের জায়গাটি স্থানীয় জমির উদ্দিনের বড় সন্তান শিক্ষানুরাগী প্রয়াত হাসান আলী ১৯৭৪ সালে মশাজান গারট্ট মৌজার নিজস্ব ২৫০ শতাংশ ভূমি ওই প্রতিষ্ঠানে দান করেন।

অত্র অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তাড়ে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপুর্ন অবদান রাখলেও ১৯৮৫ সালে এর ১৫৪ শতাংশ ভূমিবিশিষ্ট মাঠে গবাদি পশুর হাট প্রতিষ্ঠা করা হলে দিনদিনই এখানে শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে।

চল্লিশ বছর ধরে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বিদ্যালয়ের মাঠে প্রতি সপ্তাহে গবাদিপশুর হাট বসছে।

প্রথমে মাঠের এক কোণে বসলেও বর্তমানে এটি অত্র এলাকায় অন্যতম বড় পশুর হাট। শিক্ষার পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সমালোচনার মুখে বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে হাটটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। বিদ্যালয়টির প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হাটটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং স্থানীয়দের।

দানপত্র (ওয়াকফ) দলিলে পাওয়া তথ্য মতে, ‘এই ভূমি সকলের যাবতীয় কার্যে ব্যবহৃত হতে হবে এবং সকল ব্যতীত অন্য কারো ব্যক্তিগত কাজে এটি ব্যবহার হতে পারবে না। কোনো কারণে বিদ্যালয় উঠে গেলে ওই জমি হাসান আলী তথা তার ওয়ারিশ গণের নিকট আসবে।’ বিদ্যালয়ের মাঠ বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু কেনাবেচার জন্য ব্যবহৃত হওয়ার সঙ্গে দলিলে উল্লেখিত ঘোষণা বা বন্দোবস্তের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সপ্তাহের প্রতি রবিবার মাঠে গবাদিপশুর হাটের সুবিধার্থে পাঠদানের সময়েসূচিতে পরিবর্তন রাখা হয়েছে। হাটের দিন প্রতি রোববার সকাল সাড়ে আটটায় বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু হয়ে বেলা একটার সময়ে ছুটি হয়। এ ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনে সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পশুর হাটের জন্য বদলে যায় স্কুলের সময় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে গত বছর বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১১২জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও এবার এখন পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ২০১৫ সালে আট শতাধিক শিক্ষার্থী এখানে পাঠদান গ্রহণ করলেও ২০২৫ সালে মোট শিক্ষার্থী কমে হয়েছে ছয়’শ। হাটের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে শিক্ষার্থী কমছে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।

বিদ্যালয়টির উত্তর পাশের দেয়াল ঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত গারট্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী দেড় শতাধিক। এর পাশেই প্রতিষ্ঠিত কদমতলী জামে মসজিদ। গারট্র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোছাম্মত শাপলা খাতুন হাটের বেশী ভিড় হয় তখন স্কুলের শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারে অনেক সমস্যা হয়।

রবিবার হাটের দিন কদমতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সুউচ্চ সীমানা প্রাচীরে ঘেরা হাসান পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের রয়েছে সুদৃশ্য তোরণ। প্রাচীর ঘেঁষে মাঠের ভিতরে স্থায়ীভাবে বাঁশ দিয়ে খুঁটি গেড়ে গরু বেঁধে রাখার জন্য। শ্রেণিকক্ষ দালানের সামনের অংশেও দেখা যায় এসব খুঁটি। মাঠের কোথাও ঘাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনো হিংস্র গরু ছুটে গিয়ে মাঠ জুড়ে ছুটাছুটি করে আতঙ্ক ছড়ায়।

ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, ভটভটিতে দূর-দূরান্ত থেকে কৃষক আর ব্যবসায়ীরা গরু ছাগল নিয়ে হাটে আসেন। এসব যানবাহন বিদ্যালয়টির সামনের সড়কে দাঁড় করে রেখে পশু উঠানামার কাজ চলায় এদিন দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে অনেক সময় সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে জরুরী ও রোগীবাহী গাড়ির নির্বিঘ্নে চলাচলের সমস্যা তৈরি করে।

সপ্তাহে একদিন পশুর হাট বসলেও এর প্রভাব থাকে সপ্তাহ জুড়েই। খেলাধুলা বা অন্যান্য সামাজিক কর্মকান্ডের জন্যে মাঠটি সারা বছর অনুপযুক্ত থাকে। রবিবার এটি যে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা বোঝারই উপায় থাকে না। এ ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে পরিবেশ আরও ভয়াবহ হয়েও পুরো মাঠ নর্দমায় পরিণত হয়। গোবর, চোনা আর কাদাপানি দিয়ে একাকার হয়ে শ্রেনীকক্ষ ও ক্যাম্পাস রূপান্তরিত হয় ডাস্টবিনে। দুই ঈদের সময়ে একটা অতিরিক্ত ধকল পোহাতে হয় মাঠটির।

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু বকর বলেন, হাটের কারনে মাঠে খেলাধুলা করা যায় না মাঠ গরুর বিষ্ঠা দিয়ে নষ্ট হয়ে থাকে। ৭ম শ্রেনীর শিক্ষার্থী বাহাজ জানান হাটের কারনে সকালে স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়। ৭ম শ্রেনী শিক্ষার্থী জান্নাত জানান মাঠে কোন ফুল গাছ থাকলে তা হাটের গরু নষ্ট করে ফেলে এমনকি মাঠ দিয়ে দুর গন্ধ বের হয়। বিশেষ করে পরীক্ষা থাকলে চরম দুর্ভোগ ও বিপাকে পড়তে হয়। গোবরের গন্ধে হাটের পরের কয়েক দিন শ্রেণিকক্ষে বসে পাঠ গ্রহণের মনোযোগ বিনষ্ট হয়। অনেক সময় পায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ময়লা শ্রেণিকক্ষ পর্যন্ত চলে আসে। এতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যহত ও পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে মাঠ থেকে হাটটি অন্যত্র স্থানান্তরের প্রয়োজেন বলে দাবি করেন তারা।

বাস চালক মোঃ শাজাহান হোসেন বলেন, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ব্যস্ত সড়কের পাশে রোববার কদমতলী হাটে যত্রতত্র পশুবাহী যানবাহন থামিয়ে পশু উঠানামার কাজ চলায় যানজটের সৃষ্টি হয়।

চলতি বছরে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে হাটটির ইজারা নিয়েছেন স্থানীয় ইশতিয়াক আহমেদ ইজ্জত আলী। তিনি দিগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জুলহাস উদ্দিনের ভাগ্নে। গত সাত বছর (২০১৭- ২০২৫) ধরে তিনি হাটটি সরকারি দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ইজারা নিয়ে পরিচালনা করছেন।

ইজারাদার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, রোববার হাট শেষে মাঠটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নর জন্য জনবল নিয়োজিত রয়েছে। হাট সরানোর ব্যপারে আমরা কিছু জানি না সরকার যদি ব্যবস্থা নেয় তাহলে হবে। তবে হাটের লভ্যাংশ থেকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কোনো টাকা পয়সা দিতে না হলেও পার্শ্ববর্তী মসজিদের উন্নয়নে মাসে নিয়মিত ১৬ হাজার করে টাকা প্রদান করি। হাটের দিনে গড়ে কয়েক হাজার গবাদিপশুর বেচা বিক্রি হয়। প্রতি গরু বিক্রির পর সাধারণত পাঁচশ টাকা টোল আদায় হয়।

কদমতলী হাসান পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান হাটটি অন্যত্র স্থানান্তর করে বিদ্যালয়টির প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ১৯৮৫ সালে কদমতলী হাটটি স্কুলের মাঠে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নিয়মিত পশুর হাট বসছে। এতে একটা সংকটের মধ্য দিয়ে দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়। হাটটি শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট এবং শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে।

হাটের দিন ও পরের দিন শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হতে চায় না। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী দিনদিনই কমে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে শিক্ষার্থী ছিল আট শতাধিক, কিন্তু বর্তমানে ছয়শরও কম। হাট শেষে মাঠ পরিষ্কার হয় না ঠিকমতো। অভিভাবকরা তার সন্তানদের লেখাপড়ায় জন্য বিকল্প বিদ্যালয় নির্ধারণ করেন। হাটটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষকে বারবার অবহিত এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হলেও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

ঘাটাইল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, হাটের কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ যে ব্যহত হচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নাই। মাঠ থেকে হাটটি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য এর আগে নানান উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি আর কার্যকর হয়নি। বিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে হাটটি স্থানান্তর করলে হাট ও বিদ্যালয় উভয় কর্তৃপক্ষই উপকৃত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং হাসান পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মোছা. শারমিন ইসলাম জানান, বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *