পুলিশিং সমাজের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার মূল ভিত্তি। একটি কার্যকর পুলিশ বাহিনী সমাজের শান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে, বর্তমান সময়ে পুলিশের কার্যক্রম এবং তাদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
পুলিশের এমন কার্যক্রম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই, তবে পুলিশিং কার্যক্রমের প্রতি সাধারন মানুষের অতি তিক্ততা আসে সম্প্রতী কোটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ দেশের মানুষের বুকে নির্দয়ভাবে গুলি চালানোর কারনে। এতে সারাদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সর্বমহলে দেখা দেয় নানান প্রশ্ন। বাহিনীটির এমন অবস্থার জন্য সদ্য পদত্যাগী সরকারই যে দায়ী ছিল, ধীরেধীরে তা স্পষ্ট হচ্ছে।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সদ্য পদত্যাগী সরকারের আমলে পুলিশের পদোন্নতিতে হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি।
১৯৯৭ সালে ১৭১ কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দিলেও পদোন্নতির জন্য তারা যোগদানের তারিখ দেখিয়েছেন ছয় বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে।
এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে তারা উপর মহলের সহায়তায় জ্যেষ্ঠ ৭৫০ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে (সুপারিসিড) পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি নেন। পরে তাদের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পর্যন্ত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন পদোন্নতির ফলে নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন দুই হাজার ২৫০ পুলিশ কর্মকর্তা।
জালিয়াতি তো বটেই, ১৭১ জনের পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমেই যে হয়েছে, তা বললে নিশ্চই ভূল হবে না।
ইতোমধ্যে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। বাহিনীর শীর্ষসহ সব পর্যায়েই বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। পুলিশের তিন বড় কর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
আরও পড়ুন
টাঙ্গাইলের এনজিও সেতু ভবনে শাখা হিসাব রক্ষকের রহস্যজনক মৃত্যু
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা থেকে জারি করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে ১২ উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এবং ১১ পুলিশ সুপারকে (এসপি) রদবদল করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদবঞ্চিতরা পদোন্নতি ও শীর্ষপদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
শুধু রদবদলই নয়, যারা দায়িত্বে আসছেন, তারা দায়িত্ব পালনে কতটা সৎ ও জনবান্ধব হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা কেমন পুলিশ চাই?
আমরা চাই পুলিশ হোক জনগণের। পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে হবে। তাদের উচিত জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে জনগণ তাদের কাছে নিরাপত্তা ও সহায়তার জন্য আসতে পারে।
পুলিশকে জনগণের সমস্যা ও চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত পুলিশ। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উচিত আইন ও নীতিমালা মেনে চলা এবং কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা। তাদের কাজের প্রতি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা থাকতে হবে, যাতে জনগণ তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারে।
আমরা চাই প্রশিক্ষিত বাহিনী। আধুনিক পুলিশিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। পুলিশ সদস্যদের উচিত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা।
তাদেরকে মানসিক স্বাস্থ্য, মানবাধিকার এবং সংঘাত সমাধানের বিষয়ে প্রশিক্ষিত হতে হবে।
পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতে হলে, তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে পুলিশি কার্যক্রমের অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে, যাতে তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য পুলিশকে সহায়তা করতে পারে।
এছাড়া, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মানবিক গুণাবলী ও সহানুভূতি বৃদ্ধি করতে হবে। অপরাধীদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনের পরিবর্তে, তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। সমাজের একটি অংশ হিসেবে, পুলিশকে অপরাধীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করতে হবে, যাতে তারা সমাজে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
অবশেষে, প্রযুক্তির ব্যবহার পুলিশের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও নিরাপদ করে তুলতে পারে। সিসিটিভি, ড্রোন এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও তদন্তের কাজকে সহজতর করা সম্ভব। প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ বাহিনীকে আরও দক্ষ ও কার্যকরী করে তোলা যেতে পারে।
আমাদের প্রত্যাশা, পুলিশ বাহিনী যেন জনগণের সেবায় নিবেদিত, ন্যায়সঙ্গত, প্রশিক্ষিত, মানবিক এবং প্রযুক্তি-সক্ষম হয়। এই ধরনের পুলিশ বাহিনীই আমাদের সমাজকে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে সক্ষম হবে।
আমাদের উচিত পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে সহযোগিতা করা এবং তাদের প্রতি আস্থা রাখা, যাতে আমরা একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
আমরা যদি এই লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে কাজ করি, তবে আমরা একটি উন্নত, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
আমাদের সমাজের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, পুলিশের কার্যক্রমের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্র্ণ।
জনগণকে পুলিশি কার্যক্রমের অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে এবং তাদেরকে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করতে উৎসাহিত করতে হবে।
শরিফুল ইসলাম।