নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে অধিক লাভের আশায় ভুট্টা ও বাদাম চাষের জমিতে কৃষকরা নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত তামাক চাষ করছে।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য চাষের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদন নেওয়ার আইনগত বিধান থাকলেও তার তোয়াক্কা না করে অধিক লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর নতুন নতুন ফসলি জমি তামাক চাষে যুক্ত হচ্ছে।
এসব জমিতে দীর্ঘ মেয়াদে কৃষকের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁঁকি নিয়ে বেশি লাভ ও বহুজাতিক কোম্পানির অর্থায়ন ও প্রলোভনে প্রতিবছর তামাক চাষে যুক্ত হচ্ছে। ফলে জেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের কৃষি জমিতে তামাক নামীয় বিষ ছড়িয়ে পড়ছে।
তামাক চাষে ‘কারগিল’ নামক সার প্রয়োগের ফলে চাষী ও তার পরিবারের স্বাস্থ্য ঝুঁঁকি বাড়ছে এবং ফসলি জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে- জেলায় কমছে ফসলি জমির পরিমাণ।
জানাগেছে, সাধারণত চরাঞ্চলের বেলে-দো’আশ মাটি তামাক চাষের জন্য সর্বোত্তম।
টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার প্রায় সবক’টিতেই কম-বেশি তামাকের চাষ হয়। তবে ভূঞাপুর, কালিহাতী, সদর, দেলদুয়ার ও নাগরপুর- এ পাঁচ উপজেলার চরাঞ্চলে তামাকের চাষ সবচেয়ে বেশি।
এরমধ্যে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, জগৎপুরা, বামনহাটা, চরনিকলা, নিকরাইল, পালিমা, আমুলা, কালিহাতী উপজেলার
সল্লা, দেউপুর, চর হামজানী, কদিম হামজানী, পটল, বেরী পটল, জোকারচর, গোহালিয়াবাড়ী, কুর্শাবেনু, বেনুকুর্শা, গোবিন্দপুর,
ধলাটেঙ্গর, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া, হুগড়া, কাতুলী, মামুদ নগর, চর পৌলী; দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন, দেউলী,
লাউহাটি এবং নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া, ভাদ্রা, বেকরা, আটাপাড়া, সলিমাবাদ, ধুবুরিয়া, মোকনা, বনগ্রাম, শাহজানী প্রভৃতি চরাঞ্চল এলাকায় দিগন্তজুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, বহুজাতিক কোম্পানী ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী লিমিটেড, জাপান টোব্যাকো কোম্পানী
লিমিটেড, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানী সহ বিভিন্ন বিড়ি, সিগারেট ও জর্দা তৈরির প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে।
সরকারিভাবে কোনোরূপ তৎপরতা না থাকায় অধিক লাভ ও অর্থের প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
কালিহাতী উপজেলার চরাঞ্চল দুর্গাপুর ইউনিয়নের চরহামজানী, কদিমহামজানী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এতদাঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক তামাক চাষ করেন।
টোব্যাকো কোম্পানীগুলো তামাক চাষে অর্থ বিনিয়োগ করছে। ফসলি জমিতে উৎপাদনের পর তামাকগুলো তারাই কিনে
নেওয়ার নিশ্চয়তায় কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছে।
স্থানীয় তামাক চাষি আমির আলী, হারেছ মিয়া, শুকুর মামুদ সহ অনেকেই জানান, কোম্পানী (তামাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান) থেকে
তাদের বীজ, সার, কীটনাশক, ত্রিপল ও কাগজসহ উৎপাদনের যাবতীয় সামগ্রীও সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
আবার তারাই তামাক পাতা কিনে নেয়। টাঙ্গাইল জেলায় মূলত ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী ও জাপান টোব্যাকো কোম্পানী তামাক চাষে কৃষকদের সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
টাঙ্গাইল জেলায় তামাক চাষে অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী ও জাপান টোব্যাকো
কোম্পানীর স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তারা কোম্পানীর দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে থাকেন বলে জানান।
টাঙ্গাইলের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী সোমনাথ লাহিড়ী জানান, তামাক চাষে জড়িত চাষী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে
তামাক মারাত্মক নিউরো-টক্সিক ইফেক্ট তৈরি করে। মানব শরীরে দীর্ঘদিন এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকে। এছাড়া তামাক চাষ
পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তামাক চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সার ও কীটনাশক জমির উর্বরতা হ্রাস করে।
বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তামাক চাষের পূর্বে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। তাঁর মতে টাঙ্গাইলে তামাক চাষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়না।
তিনি আরও জানান, ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান দাদন হিসেবে অগ্রীম টাকা দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। গ্রামের অসহায় কৃষকরা না বুঝে তাদের জমি ও জীবনের চরম ক্ষতি করছে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে গণসচেতনতা এবং তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা দরকার।
তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয় চিকিৎসক ডা. জিল্লুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন তামাক চাষে যুক্ত থাকলে মানব শরীরে
ক্যান্সার, পেটের পীড়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, চর্ম, বুক ও ঘাড়ে ব্যথাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
এছাড়া তামাক চাষিদের সন্তানদের ‘গ্রিণ টোব্যাকো সিন্ড্রম’ নামে এক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তামাকজাত দ্রব্য এড়াতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আশেক পারভেজ জানান, তামাক চাষের বিষয়ে সরকারিভাবে তাদের উপর কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
তাই এক্ষেত্রে তারা কোনো মতামত ও তামাক চাষে হস্তক্ষেপ করেন না।
তবে স্বস্থ্য সচেতনতায় তারা কৃষকদেরকে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। তিনিও মনে করেন, এ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।