সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রমিক

সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রমিক

অনলাইন ডেস্ক : সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রমিক। দেশের অর্থনীতির তিন চালিকাশক্তি-কৃষি, গার্মেন্ট ও রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়)। স্বস্তা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এ খাতগুলোকে অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়। এ তিন খাতের সঙ্গেই শ্রমিকদের সম্পর্ক বেশি।

অর্থাৎ অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন শ্রমিকরা। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও থেমে নেই তারা। কিন্তু আজ তারা ভালো নেই। কম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে।

প্রতিবছর মে দিবস এলেই শ্রমিকদের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর সবাই ভুলে যায়। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও জাতীয় মজুরি কমিশন গঠিত হয়নি। সবকিছু মিলে শ্রমিকরা যে টাকা আয় করছেন, তা দিয়ে সংসার একেবারেই চলছে না।

এছাড়া কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের অভাব এবং দেশের অর্থনৈতিক নানা সংকটে প্রতিনিয়ত কাজ হারাচ্ছেন। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ। ন্যূনতম মজুরি নেই ৫০টির বেশি খাতে।

অন্যদিকে করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এতে দুর্দিন যাচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদেরও। অর্থাৎ আগামী দিনে ভালো দিন আসছে, এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের মতো শ্রমঘন শিল্পপ্রধান দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেশে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার। কিন্তু সরকার বলছে, বেকার মাত্র ২৬ লাখ। পর্যায়ক্রমে আরও কমছে।

জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই শ্রমিক। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছেন। শ্রমিকের ওপর ভর করেই শক্তিশালী হচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির আকার বড় হলেও আয়বৈষম্য ব্যাপক। এ বৈষম্য কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতির যে হিসাব ছিল,
করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংকট সবকিছুই পালটে দিয়েছে। শ্রমিকদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।

তার মতে, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি হলো বেশির ভাগ মানুষ কর্মক্ষম। এদের মজুরিও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম।
তবে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে শ্রমিকদের দক্ষতার অভাব রয়েছে।

জনশক্তি এখনো সম্পদে পরিণত হয়নি। ফলে শ্রমিকদের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগানো যায়নি। তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে।
কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। এ কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি।

এ অবস্থার উত্তরণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে এ জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের অর্থ সম্পাদক কাজী মো. রুহুল আমিন বলেন,
৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যেও কৃষি শ্রমিকরা কাজ করে ফসল উৎপাদন করছেন। কিন্তু তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত।
শিল্প খাতের শ্রমিকরাও নানাভাবে বঞ্চিত।

স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরেও জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন করা হয়নি। অধিকাংশ শ্রম খাতে ন্যূনতম মজুরি নেই।
শ্রমিকরা যা বেতন পান, তা নিয়ে সংসার চলে না। তাদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নেই।
ফলে এবারের মে দিবসে আমাদের দাবি-শ্রমিকদের জন্য সর্বজনীন রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

জানা যায়, শ্রম আইন ২০০৬ সালের ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে, শ্রমিক হলো ওই ব্যক্তি, যিনি তার চাকরির শর্ত পালন করে
কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরি কাজে নিযুক্ত।

এছাড়া ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা
কেরানিগিরির কাজে নিয়োজিতদেরও শ্রমিক বলা যাবে। মূলত শ্রমিকদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

এগুলো হলো-অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) যেমন: দোকানপাট, ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষিকাজ ইত্যাদিকে বিবিএস চিহ্নিত করেছে।
আর আনুষ্ঠানিক (ফরমাল) ক্ষেত্র হলো-সরকারি অফিস-আদালত, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

আবার মোট শ্রমিকের মধ্যে ৮৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে। মূলত তারা রিকশাচালক, কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, হকার,
ভাঙারি সংগ্রহকারী, পরিবহণ শ্রমিক এবং খণ্ডকালীন গৃহকর্মী প্রভৃতি বাকি ১৩ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে।
পেশার দিক থেকে কৃষক, মৎস্যজীবীর সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তির জরিপ অনুসারে বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার।
এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। গ

ত ৬ বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা কমে ২৬ লাখ ৩০ হাজারে নেমেছে। ২০১৬ সালে যা ছিল ২৭ লাখ।
এসব ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ পাননি। তবে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সি শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ কোটি ৬৯ লাখ।

দেশের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মতে, এ মানুষগুলো বেকার। কিন্তু এদের বেকার বলতে রাজি নয় বিবিএস।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদণ্ড অনুযায়ী, সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসাবে ধরা হয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির হিসাবে প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছে।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ নতুন শ্রমিকদের বড় অংশই বেকার থেকে যাচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সেবা খাতের অবদান ৫৬ শতাংশ, শিল্পের ৩৩ এবং কৃষি খাতের ১৩ শতাংশ।

আবার জিডিপির সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যোগ করলে হয় জাতীয় আয়।
বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পড়ে।
অর্থনীতির এ অর্জনের পেছনে শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি।

দেশের শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে নতুন কর্মশক্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি মৌলিক শক্তির মধ্যে রয়েছে কৃষি, রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্ট।
তিনটি শক্তির সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। তৈরি পোশাক, কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে প্রতিদিনই নতুন শ্রমশক্তি আসছে।

তারাই তাদের মেধা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা সেভাবে মজুরি পাচ্ছেন না।
এখনো দেশে ৫০টির বেশি খাতে ন্যূনতম মজুরি নেই।

ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির বিশাল পার্থক্য।
কোনো খাতের মজুরি ২ হাজার টাকা, আবার কোনো খাতে ১৬ হাজার টাকার বেশি।
তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা।

গার্মেন্ট মালিকদের বিজিএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নজরুল ইসলাম মনে করেন, শ্রমিকদের রেশনিং ব্যবস্থা করতে হলে সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।

ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে শ্রমিকরা যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সেখানে তারা তা পান না। অনেকটা ‘মিস ইউজ’ হয়।
কোনো মালিক ট্রেড ইউনিয়নের বিপক্ষে না। তারা ভয় পান ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে থেকে যারা কলকাঠি নাড়েন তাদের।
এদিকে বর্তমানে সব খাতের শ্রমিকের দুর্দিন চলছে।
এর অন্যতম কারণ জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, ওইভাবে আয় বাড়েনি।

বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশ। কিন্তু বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে তা আরও বেশি।
অর্থাৎ ব্যয়ের সঙ্গে সমানভাবে আয় বাড়ছে না। এছাড়াও দেশে নতুন বিনিয়োগ নেই। ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান।
এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে টিকে থাকাই কঠিন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুসারে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

জাতিসংঘের এই সংস্থা বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট আর দেখা দেয়নি। জানতে চাইলে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান
বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, আমরা জনশক্তি বোনাস পেয়েছি। এটি ইতিবাচক দিক।
কিন্তু মূল কথা হলো, জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান দরকার। পাশাপাশি দক্ষ করে তুলতে হবে জনশক্তিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *